গোরা ৬৩

গোরা   
৬৩

সুচরিতার সম্মুখে গোরা যেমন করিয়া কথা কহিয়াছে এমন আর কাহারো কাছে কহে নাই। এতদিন সে তাহার শ্রোতাদের কাছে নিজের মধ্য হইতে কেবল বাক্যকে, মতকে, উপদেশকে বাহির করিয়া আসিয়াছে--আজ সুচরিতার সম্মুখে সে নিজের মধ্য হইতে নিজেকেই বাহির করিল। এই আত্মপ্রকাশের আনন্দে, শুধু শক্তিতে নহে, একটা রসে তাহার সমস্ত মত ও সংকল্প পরিপূর্ণ হইয়া উঠল। একটি সৌন্দর্যশ্রী তাহার জীবনকে বেষ্টন করিয়া ধরিল। তাহার তপস্যার উপর যেন সহসা দেবতারা অমৃত বর্ষণ করিলেন।

গোরা ৬৪

গোরা   
৬৪

মাঝখানে নিজের একটুখানি আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছিল এই কথা স্মরণ করিয়া গোরা পূর্বের চেয়ে আরো বেশি কড়া হইয়া উঠিল। সে যে সমাজকে ভুলিয়া প্রবল একটা মোহে অভিভূত হইয়াছিল নিয়মপালনের শৈথিল্যকেই সে তাহার কারণ বলিয়া স্থির করিয়াছিল।

গোরা ৬৫

গোরা   
৬৫

হরিমোহিনী তাঁহার দেবর কৈলাসের নিকিট হইতে পত্র পাইয়াছেন। তিনি লিখিতেছেন, "শ্রীচরণাশীর্বাদে অত্রস্থ মঙ্গল, আপনকার কুশলসমাচারে আমাদের চিন্তা দূর করিবেন।'

গোরা ৬৬

গোরা   
৬৬

সুচরিতা পরেশের কাছে যে কথা কয়টি শুনিল তাহা গোরাকে বলিবার জন্য তাহার মন অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিল। যে ভারতবর্ষের অভিমুখে গোরা তাহার দৃষ্টিকে প্রসারিত এবং চিত্তকে প্রবল প্রেমে আকৃষ্ট করিয়াছে, এত দিন পরে সেই ভারতবর্ষে কালের হস্ত পড়িয়াছে, সেই ভারতবর্ষ ক্ষয়ের মুখে চলিয়াছে, সে কথা কি গোরা চিন্তা করেন নাই? এতদিন ভারতবর্ষ নিজেকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে তাহার আভ্যন্তরিক ব্যবস্থার বলে; সেজন্য ভারতবাসীকে সতর্ক হইয়া চেষ্টা করিতে হয় নাই। আর কি তেমন নিশ্চিন্ত হইয়া বাঁচিবার সময় আছে? আজ কি পূর্বের মতো কেবল পুরাতন ব্যবস্থাকে আশ্রয় করিয়া ঘরের মধ্যে বসিয়া থাকিতে পারি?

গোরা ৬৭

গোরা   
৬৭

কারাগার হইতে বাহির হওয়ার পর হইতে গোরার কাছে সমস্ত দিন এত লোক-সমাগম হইতে লাগিল যে তাহাদের স্তবস্তুতি ও আলাপ-আলোচনার নিশ্বাসরোধকর অজস্র বাক্যরাশির মধ্যে বাড়িতে বাস করা তাহার পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল।

গোরা ৬৮

গোরা   
৬৮

গায়ে তসরের চায়না কোট, কোমরে একটা চাদর জড়ানো, হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ--স্বয়ং কৈলাস আসিয়া হরিমোহিনীকে প্রণাম করিল। তাহার বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি হইবে, বেঁটেখাটো আঁটসাঁট মজবুত গোছের চেহারা, কামানো গোঁফদাড়ি কিছুদিন ক্ষৌরকর্মের অভাবে কুশাগ্রের ন্যায় অঙ্কুরিত হইয়া উঠিয়াছে।

গোরা ৬৯

গোরা   
৬৯

গোরা আজকাল সকালেই বাড়ি হইতে বাহির হইয়া যায়, বিনয় তাহা জানিত, এইজন্য অন্ধকার থাকিতেই সোমবার দিন প্রত্যুষে সে তাহার বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল; একেবারে উপরে উঠিয়া তাহার শয়নগৃহে গেল। সেখানে গোরাকে দেখিতে না পাইয়া চাকরের কাছে সন্ধান লইয়া জানিল, সে ঠাকুরঘরে আছে। ইহাতে সে মনে মনে কিছু আশ্চর্য হইল। ঠাকুরঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া দেখিল, গোরা পূজার ভাবে বসিয়া আছে; একটি গরদের ধুতি পরা, গায়ে একটি গরদের চাদর, কিন্তু তাহার বিপুল শুভ্রদেহের অধিকাংশই অনাবৃত। বিনয় গোরাকে পূজা করিতে দেখিয়া আরো আশ্চর্য হইয়া গেল।

গোরা ৭০

গোরা   
৭০

অনেক দিন পীড়নের পর এ কয়েক দিন আনন্দময়ীর কাছে সুচরিতা যেমন আরাম পাইল এমন সে কোনোদিন পায় নাই। আনন্দময়ী এমনি সহজে তাহাকে এত কাছে টানিয়া লইয়াছেন যে, কোনোদিন যে তিনি তাহার অপরিচিতা বা দূর ছিলেন তাহা সুচরিতা মনেও করিতে পারে না। তিনি কেমন একরকম করিয়া সুচরিতার সমস্ত মনটা যেন বুঝিয়া লইয়াছেন এবং কোনো কথা না কহিয়াও তিনি সুচরিতাকে যেন একটা গভীর সান্ত্বনা দান

গোরা ৭১

গোরা   
৭১

এই আঘাতে গোরার মনে একটা পরিবর্তন আসিল। সুচরিতার দ্বারা গোরার মন যে আক্রান্ত হইয়াছে তাহার কারণ সে ভাবিয়া দেখিল--সে ইহাদের সঙ্গে মিশিয়াছে, কখন্‌ নিজের অগোচরে সে ইহাদের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করিয়া ফেলিয়াছে। যেখানে নিষেধের সীমা টানা ছিল সেই সীমা গোরা দম্ভভরে লঙ্ঘন করিয়াছে।

গোরা ৭২

গোরা   
৭২

গঙ্গার ধারে বাগানে প্রায়শ্চিত্তসভার আয়োজন হইতে লাগিল।



অবিনাশের মনে একটা আক্ষেপ বোধ হইতেছিল যে, কলিকাতার বাহিরে অনুষ্ঠানটা ঘটিতেছে, ইহাতে লোকের চক্ষু তেমন করিয়া আকৃষ্ট হইবে না। অবিনাশ জানিত, গোরার নিজের জন্য প্রায়শ্চিত্তের কোনো প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন দেশের লোকের জন্য। মরাল এফেক্‌ট্‌! এইজন্য ভিড়ের মধ্যে এ কাজ দরকার।

গোরা ৭৩

গোরা   
৭৩

কাল প্রায়শ্চিত্তসভা বসিবে, আজ রাত্রি হইতেই গোরা বাগানে গিয়া বাস করিবে এইরূপ স্থির আছে। যখন সে যাত্রা করিবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় হরিমোহিনী আসিয়া উপস্থিত। তাঁহাকে দেখিয়া গোরা প্রসন্নতা অনুভব করিল না। গোরা কহিল, "আপনি এসেছেন--আমাকে যে এখনই বেরোতে হবে--মাও তো কয়েক দিন বাড়িতে নেই। যদি তাঁর সঙ্গে প্রয়োজন থাকে তা হলে--"

গোরা ৭৪

গোরা   
৭৪

গোরা কহিল--"না। প্রায়শ্চিত্ত কাল না। আজই আমার প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হয়েছে। কালকের চেয়ে ঢের বড়ো আগুন আজ জ্বলেছে। আমার নবজীবনের আরম্ভে খুব একটা বড়ো আহুতি আমাকে দিতে হবে বলেই বিধাতা আমার মনে এতবড়ো একটা প্রবল বাসনাকে জাগিয়ে তুলেছেন। নইলে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কেন?

গোরা ৭৫

গোরা   
৭৫

গোরা লিখনটি লিখিয়া যখন হরিমোহিনীর হাতে দিল তখন তাহার মনে হইল সুচরিতা সম্বন্ধে সে যেন ত্যাগপত্র লিখিয়া দিল। কিন্তু দলিল লিখিয়া দিলেই তো তখনই কাজ শেষ হয় না। তাহার হৃদয় যে সে দলিলকে একেবারে অগ্রাহ্য করিয়া দিল। সে দলিলে কেবল গোরার ইচ্ছাশক্তি জোর কলমে নামসই করিয়া দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহার হৃদয়ের স্বাক্ষর তো তাহাতে ছিল না--

গোরা ৭৬

গোরা   
৭৬

সুচরিতা যখন চোখের জল লুকাইবার জন্য তোরঙ্গের 'পরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া কাপড় সাজাইতে ব্যস্ত ছিল এমন সময় খবর আসিল, গৌরমোহনবাবু আসিয়াছেন।

গোরা পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট

গোরা সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখিল--আনন্দময়ী তাঁহার ঘরের সম্মুখে বারান্দায় নীরবে বসিয়া আছেন।



গোরা আসিয়াই তাঁহার দুই পা টানিয়া লইয়া পায়ের উপর মাথা রাখিল। আনন্দময়ী দুই হাত দিয়া তাহার মাথা তুলিয়া লইয়া চুম্বন করিলেন।